Monday, August 29, 2011

সংগীত শিল্পীদের মঞ্চভীতি দূর করার অভিনব এক উদ্যোগ

পরীক্ষা বা চাকরির ইন্টারভিউ'এর আগে অনেকের মনেই দেখা দেয় তীব্র আতঙ্ক৷ বহু পেশাদার সংগীত শিল্পীও জনসমক্ষে অনুষ্ঠান করতে গেলে বেশ ঘাবড়ে যান৷ ধীরে ধীরে হয়ে পড়েন মানসিক রোগের শিকার৷

অনেক পেশাদার সংগীত শিল্পী অনুষ্ঠানের আগে এতই নার্ভাস হয়ে পড়েন যে, তাদের হৃদকম্প শুরু হয়, হাত পা কাঁপতে থাকে, অসুস্থও হয়ে পড়েন কেউ কেউ৷ এ সম্পর্কে শোনা যাক দুজন শিল্পীর কথা৷ এক বেহালা শিল্পী জানান, ‘‘আমার হাত কাঁপতে থাকে৷ বেহালা বাজাবার জন্য ধনুকটি ঠিকমত ধরে রাখতে পারিনা৷ নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলি৷ অবস্থাটা খারাপের দিকেই যেতে থাকে ক্রমশ৷''

আরেক কন্ঠশিল্পী জানান, ‘‘মনে হয়ে সুইচ টিপে সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ আমি স্পষ্ট কোনো চিন্তা করতে পারিনা৷ গান গাওয়া তো দূরের কথা, কেননা নিঃশ্বাস প্রশ্বাস কনসার্টে বাজানোর সময়ও ভুল করার ভয় থাকতে পারে
ওঠানামা করতে থাকে, কন্ঠস্বর কাঁপতে থাকে৷'' 

অনুষ্ঠান করাটা অনেক শিল্পীর কাছে শাস্তি বলে মনে হয়

এই ভাবেই ঘাবড়ে যান বহু থিয়েটার ও কনসার্ট শিল্পী অনুষ্ঠানের আগের মুহূর্তে৷ বুক দুরুদুরু করতে থাকে, কাঁপতে থাকে হাতপা৷ অনেককেই ভয়টা এইভাবে পেয়ে বসে যে, অনুষ্ঠান করাটা রীতিমত শাস্তি বলে মনে হয়৷ এই সব শিল্পীর সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন বন বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিকের স্নায়ু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ম্যাহকোর্ন৷ তিনি নিজেও পিয়ানো বাদক বা গায়িকা হতে চেয়েছিলেন, পরে অবশ্য চিকিত্সাবিদ্যা বিশেষ করে মনোরোগকে বেছে নেন৷ পেশাদার সংগীত শিল্পীদের জনসমক্ষে অনুষ্ঠান পরিবেশনের আগে ঘাবড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে গবেষণা করছেন এখন ডা. ম্যাহকর্ন৷ এই সব শিল্পীকে সাহায্য করার জন্য বন ইউনিভার্সিটি ক্লিনিকে একটি বিশেষ বিভাগ খুলেছেন তিনি৷ এই প্রসঙ্গে ডা. ম্যাহকোর্ন জানান, ‘‘বহু শিল্পীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার৷ আমার স্বামীও একজন সংগীত শিল্পী৷ শিল্পীদের মঞ্চে যাওয়ার আতঙ্ক সম্পর্কে প্রায়ই শুনেছি তাঁর কাছে৷ আমার অনেক শিল্পী বন্ধুও তাঁদের এই সমস্যার কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরা জানিনা কোথায় গেলে সাহায্য পাব৷ আমাদের সমস্যা বুঝতে পারে, এমন থেরাপিস্টও খুব কম৷' তাঁদের এই সমস্যার কথা আমার মাথা থেকে যায়নি৷ অবশেষে এক্ষেত্রে সাহায্যের জন্য একটি বিশেষ বিভাগ খোলার উদ্যোগ নেই আমি৷ রোগীরা অনেক আগ্রহ নিয়ে আমাদের কাছে আসেন৷ তাঁদের সঙ্গে কাজ করাটা খুবই আনন্দের৷''  

বহু শিল্পী সাহায্যের আশায় আসছেন ক্লিনিকে
ইতোমধ্যে মঞ্চ আতঙ্ক দূর করার এই ক্লিনিকটির কথা ভুক্তভোগীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাই প্রতিদিনই সাহায্যের আশায় বহু শিল্পী আসছেন এখানে৷ এই ধরনের ভীতি উপযুক্ত ট্রেনিং ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কমানো যায়৷ তবে এজন্য কিছুটা ধৈর্যের প্রয়োজন৷ ছোট্ট একটি বাগান সংলগ্ন ঘরে থেরাপি দেয়া হয়৷ এই রকম পরিবেশে রোগীরাও মন খুলে কথা বলতে পারেন৷ ডা. ম্যাহকর্নের ভাষায়, ‘‘রোগীদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ সংগীতের ক্লাসে তাঁদের কীরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে, মা বাবার প্রত্যাশাই বা কীরম ছিল, সেসব আমরা জানার চেষ্টা করি৷ তারপর যে পরিবেশে তাঁদের আতঙ্ক দেখা দেয় এবং যে ভাবে তাঁরা এই অবস্থা মোকাবেলার চেষ্টা করেন সেটা বোঝার চেষ্টা করি৷ আতঙ্ক দূর করার চেয়ে রোগীদের নেতিবাচক মনোভাব দূর ঘাবড়ে গেলে আরও ভুল হতে পারে
করাটা বেশি জরুরি৷''ঘাবড়ে গেলে আরও ভুল হতে পারে

ব্যাপারটা অবশ্য সহজ নয়৷ কেননা শিল্পী মহলে মঞ্চ ভীতি নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করা হয়না৷ মনে করা হয় এটা দুর্বলতার পরিচায়ক৷ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ম্যাহকর্ন এখন জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অর্কেস্ট্রা ও থিয়েটার শিল্পীদের সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন৷ সেসব তিনি বছরের শেষ নাগাদ একটি সমীক্ষায় তুলে ধরবেন৷ ফলে অনেক ভুক্তভোগীই মঞ্চ আতঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারবেন বলে আশা করেন ডা. ম্যাহকর্ন৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আতঙ্ক জনিত সমস্যায় আচরণ থেরাপি সুফল বয়ে আনে৷ ভীতির কারণগুলি বিশ্লেষণ করে সেই রকম পরিবেশ সৃষ্টি করে ট্রেনিং দেয়া হয়৷ এই ভাবে ভীতির অনুভূতিটা কমে গিয়ে বেড়ে যায় আত্মবিশ্বাস৷''

ভীতি দিয়ে ভীতি দূর করা

রোগীদের হোমটাস্ক দেয়া হয়, যার লক্ষ্য ভীতি উদ্দীপক পরিবেশে নিজেকে নিয়ে যাওয়া৷ অর্কেস্ট্রার এক সংগীত শিল্পীর কাছে কিছু সংগীতাংশ দুরূহ মনে হত৷ অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতে গেলে বক্ষ দুরুদুরু করতো তাঁর৷ এই ভীতি ভাঙতে সংগীত পরিবেশন শুরু করেন তিনি পথে পথে৷ ধীরে ধীরে আতঙ্ক দূর হয়ে যায় তাঁর৷ সংগীতের পেশায় আনন্দও খুঁজে পান৷ এ প্রসঙ্গে ডা. ম্যাহকর্ন জানান, ‘‘রোগীর অবস্থার ওপর নির্ভর করে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা৷ অনেকে ৩/৪ ঘন্টা থেরাপির পর আত্মবিশ্বাস ফিরে পান৷ অনেক রোগী মাসে একবার পরপর ২/৩ দিন আসেন আমাদের কাছে৷ আবার কেউ কেউ প্রতি সপ্তাহে একবার আসেন৷ ২০ ঘন্টা থেরাপির পর বলতে সক্ষম হন, ‘এখন আমি একাই এগিয়ে যেতে পারব৷' আমাকে আর তাঁদের প্রয়োজন হয়না, আর এটাই আমার লক্ষ্য৷''

লিখেছেনঃ  রায়হানা বেগম 

0 comments:

Post a Comment